ক্রিপ্টোকারেন্সি কি? ইতিহাস, প্রভাব এবং ভবিষ্যৎ অর্থনীতিতে এর ভূমিকা
ক্রিপ্টোকারেন্সি কি? কেন ক্রিপ্টোকারেন্সি তৈরি করা হলো? বিশ্ব অর্থনীতিতে ক্রিপ্টোকারেন্সির প্রভাব। এই আর্টিকেলে সবকিছু বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা হয়েছে। আরো তুলে ধরা হয়েছে ক্রিপ্টোকারেন্সির ভবিষ্যৎ ও বৈধতার সম্ভবনা।

ক্রিপ্টোকারেন্সিঃ আধুনিক বিশ্বের ডিজিটাক মুদ্রা বিপ্লব
ক্রিপ্টোকারেন্সি কি?
ক্রিপ্টোকারেন্সি হলো একটি ডিজিটাল বা ভার্সুয়াল মুদ্রা। এই ক্রিপ্টোকারেন্সির নিরাপত্তা ক্রিপ্টোগ্রাফির মাধ্যমে প্রদান করা হয়। ক্রিপ্টোকারেন্সি কোন কতৃপক্ষ বা সেন্ট্রাল ব্যাংক অথবা রাষ্টের কোন নিয়ন্ত্রক সংস্থা দ্বারা পরিচালিত নয়। ক্রিপ্টোকারেন্সি একটি বিকেন্দ্রিভূত নেটওয়ার্ক ব্লকচেইন প্রযুক্তির উপর ভিত্তি করে পরিচালিত। প্রতিটি লেনদেন হিস্ট্রি ব্লকে রেকর্ড থাকে এবং পাবলিক লেজার এর মাধ্যমে সুরক্ষিত থাকে। ক্রিপ্টোকারেন্সির মধ্যে সবচাইতে জনপ্রিয় হলো বিটকয়েন, ইথিরিয়াম ইত্যাদি।
ক্রিপ্টোকারেন্সির ইতিহাস
আধুনিক বিশ্বে ক্রিপ্টোকারেন্সির আভির্ভাব এর ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে যুক্ত হয় নতুন মাত্রা। ব্লকচেইন সিস্টেম এর মাধ্যমে পূর্বের যেকোন সময়ের চেয়ে দ্রুত লেনদনে সম্ভব হচ্ছে। ধারণা করা হয় ১৯৮০ এবং ১৯৯০ দশকের দিকে যখন ডিজিটাল ক্যাশ নিয়ে গবেষণা শুরু হয় তখন ব্লকচেইন সিস্টেম এর ধারণা আসে। তবে উক্ত সময়ে কেউই এর বাস্তব প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়নি।
২০০৮ সালে "Satoshi Nakamoto" নামে একজন ব্যাক্তি বা একটি দল বিটকয়েন এর শ্বেতপত্র (whitepaper) প্রকাশ করেন। ২০০৯ সালে সর্বপ্রথম বিটকয়েন সফটওয়্যার চালু হয়। ব্লকচেইন ভিত্তিক প্রথম ক্রিপ্টোকারেন্সি হিসেবে বিটকয়েন ইতিহাস সৃষ্টি করে।
কে বা কারা ক্রিপ্টোকারেন্সি সৃষ্টি করেছেন?
যদিও বিটকয়েন এর জনক হিসেবে Satoshi Nakamoto এই নামটি কে সবার সামনে আনা হয়েছে। কিন্তু তার পরিচয় আজো বিশ্ব জানতে পারেনি। এখনো কেউ এটাই জানে না Satoshi Nakamoto কোন ব্যাক্তি নাকি একটি টিম। Satoshi Nakamoto সর্বপ্রথম ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডিজিটাল মুদ্রা তৈরি করেন। এই বিটকয়েনকে সেন্ট্রাল করে বিশ্বে ডিসেন্ট্রালাইজড একটি অর্থনীতি গড়ে তুলেন।
ক্রিপ্টোকারন্সি সৃষ্টির উদ্দেশ্য কি?
প্রতিটা আবিস্কার এর পিছনে কোন না কোন উদ্দেশ্য থাকে। হতে পারে কোন ভালো উদ্দেশ্য আবার হতে পারে সুদূরপ্রসারি কোন মন্দ উদ্দেশ্য। ক্রিপ্টোকারেন্সি সৃষ্টির পিছনে আপাতত আমরা পজেটিভ বিষয় লক্ষ্য করতেছি। তবে সব সময় সব পজেটিভ যে পজেটিভ কাজ করবে তা কিন্তু নয়। আসুন জেনে নেই কি উদ্দেশ্যে ক্রিপ্টোকারেন্সি সৃষ্টি করা হয়েছে।
- রাষ্ট্রিয় হস্তক্ষেপ, সেন্ট্রাল ব্যাংক বা অন্য কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠান এর মধ্যস্থতা ছাড়াই একটি স্বাধীন লেনদেন ব্যাবস্থা তৈরি।
- লেনদেনে আর্থিক প্রতারণা, লেনদেন এর ফি এবং মধ্যস্থতাকারীদের প্রভাব নিস্ক্রিয় করা।
- বিশ্বব্যাপী, স্বল্প খরচ এবং দ্রুত লেনদেন এর জন্য
- ২০০৮ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে সংকট সৃষ্টি হওয়ায় বিকল্প ফাইন্যান্স সিস্টেম প্রতিষ্ঠা
উল্লিখিত বিষয় সমূহ সার্বিক বিবেচনায় পরিলক্ষিত হয়। আসলে এর বাস্তব উদ্দেশ্য সম্পর্কে কেউই পরিপূর্ণ তথ্য জানে না।
ক্রিপ্টোকারেন্সির প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে কি ধরনের পরিবর্তন এসেছে
বিশ্বের মানুষ তথ্য প্রযুক্তির একটি শিখরে অবস্থান করছে। মানুষ এখন নতুন নতুন টেকনোলজির প্রতি বিশেষ আগ্রহী। মানুষের এই আগ্রহকে কাজে লাগিয়ে অনেকেই অনেক টেকনোলজি সামনে নিয়ে আসতেছে। ধরুন মোবাইল প্রযুক্তি প্রতিনিয়ত নতুন নতুন চমক দিয়ে চলেছে।
ক্রিপ্টোকারেন্সি আবিস্কার এর ফলে অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত করে। মানুষ এই নতুন অর্থনৈতিক টেকনোলজিকে পছন্দ করতে শুরু করে। কিন্তু এই ডিজিটাল অর্থ ব্যাবস্থা সব যায়গায় একটি প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়।
ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান এর মধ্যস্থতা ছাড়াই লেনদেন এর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশগুলতে ব্যাংকিং সেবা সবার ক্ষেত্রে প্রজোয্য নয়। এসব ব্যাক্তির জন্য ক্রিপ্টো একটি নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছে।
স্বর্ণের বিকল্প হিসেবে অনেকেই বিটকয়েনকে ডিজিটাল গোল্ড নামে ডাকা শুরু করেছে। মানুষ এই ভার্সুয়াল কারেন্সিতে প্রচুর বিনিয়োগ করতেছে।
স্মার্ট কন্ট্রাক্ট ও ব্লকচেইন প্রযুক্তি বিশ্বের বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে স্বয়ংক্রিয়তা ও স্বচ্চতা বৃদ্ধি করেছে।
বিশ্ব ফাইন্যান্স মার্কেটে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। মার্কেট প্রাইস খুবই অস্থির থাকায় বিনিয়োগকারীদের জন্য ঝুকি তৈরি করেছে।
ক্রিপ্টোকারেন্সি মানব জীবন ও বিশ্ব অর্থনীতিতে ভবিষ্যতে কি ধরনের প্রভাব পড়তে পারে
- বিকল্প অর্থ ব্যবস্থাঃ ক্রিপ্টোকারন্সি রাষ্ট্রিয় মুদ্রার ওপর নির্ভরতা কমাতে পারে। কারন ক্রিপ্টোর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী লেনদেন করা যায় এবং কোন প্রকার সীমাবদ্ধতা নেই। কিন্তু রাষ্ট্রিয় ভাবে লেনদেন এর ক্ষেত্রে সময়, জবাবদিহিতা এবং বিশ্বব্যাপী লেনদেন এর ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতার কারনে মানুষ বিকল্প হিসেবে ক্রিপ্টোকে বেছে নিতে পছন্দ করতেছে।
- নতুন নতুন কর্মসংস্থানঃ ব্লকচেইন ডেভেলপার, এনএফটি মার্কেটার, ডেটা অ্যানালিস্ট ইত্যাদি ক্ষেত্রে নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে।
- ব্যাক্তি পর্যায়ে লেনদেন এর স্বাধীনতাঃ রাষ্ট্রিয় মুদ্রায় বিশ্বের অন্য প্রান্তে বা ভিন্ন দেশে আর্থিক লেনদেন এর ক্ষেত্রে অনেক সীমাবদ্ধতা থাকে। লেনদেন এর ক্ষেত্রে ফি, সময় ও স্বাধীনতায় সবকিছুতেই হস্তক্ষেপ থাকে। কিন্তু ক্রিপ্টোকারেন্সিতে এসব ঝামেলা ছাড়াই খুব সহজে লেনদেন করা যায়। যার ফলে এটি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
- বিনিয়োগ ও আয়ের সুযোগঃ P2P (Peer to Peer) বিনিয়োগের মাধ্যমে আয় করা সহজ হয়েছে।
ক্রিপ্টোকারেন্সির বৈধতা
ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ডিজিটাল মুদ্রা যা বিকল্প এক অর্থনীতি। এর বৈধতা নিয়ে রয়েছে নানা জল্পনা ও কল্পনা। কেউ কেউ প্রত্যাশা করেন খুব দ্রুত ক্রিপ্টোকারেন্সি বিশ্বে বৈধতা অর্জন করবে। যদিও এইতা সম্ভব হতে পারে তবে কিছু বাধা রয়েছে। কিছু দেশ ক্রিপ্টোকারেন্সিকে স্বীকৃতি দিয়েছে, এদের মধ্যে জাপান ও সুইজারল্যান্ড অন্যতম। চীন ও বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার ও লেনদেন নিষিদ্ধ রেখেছে। বিশ্বব্যাপী ক্রিপ্টোকারেন্সির আইনগত স্বীকৃতি এখন স্পষ্ট কোন বার্তা দেয়নি।
ক্রিপ্টোকারেন্সি বৈধতার ক্ষেত্রে প্রধান বাধাসমূহ
-
নিয়ন্ত্রণহীনতা ও অবৈধ কার্যকলাপ: হ্যাকিং, মানি লন্ডারিং, সন্ত্রাসে অর্থায়নের মতো অভিযোগ ক্রিপ্টোকারেন্সিকে অবিশ্বস্ত করে তুলেছে।
-
মূল্য অস্থিরতা: বিটকয়েন বা ইথেরিয়ামের মূল্য হঠাৎ অনেকটা কমে যেতে পারে, যা বৈধ মুদ্রা হিসেবে ব্যবহারকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।
-
প্রযুক্তিগত বাধা ও গ্রহণযোগ্যতা: উন্নয়নশীল দেশের প্রযুক্তিগত অবকাঠামো এখনো পুরোপুরি প্রস্তুত নয়।
-
সরকারি নিয়ন্ত্রণের অভাব: কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা সরকারের নিয়ন্ত্রণে না থাকায় নীতিনির্ধারণ কঠিন।
ক্রিপ্টোকারন্সি বিশ্ব অর্থনীতিকে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এর দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যদি এটি এখন বিশ্বব্যাপী পরিপূর্ণ বৈধতা পায়নি তবে একে অবহেলা করার কোন সুযোগ নেই। ক্রিপ্টোকারেন্সি ভবিষ্যতে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যাবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পারে। তবে এর বৈধতা, নিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা ও প্রযুক্তিগত কাঠামোর বযাপক উন্নয়ণ ঘটানো দরকার।
What's Your Reaction?






