ব্রেটন উডস চুক্তি কী? ইতিহাস, উদ্দেশ্য ও এর পতনের কারণ | Forex School

জানুন ব্রেটন উডস চুক্তি কী, কেন এটি গৃহীত হয়েছিলো, এর উদ্দেশ্য, ফলাফল ও বাতিলের পেছনের কারণ। বিশ্ব অর্থনীতিতে এই চুক্তির প্রভাব বিশ্লেষণ করুন।

Jul 5, 2025 - 11:52
Jul 5, 2025 - 13:43
 0  1
ব্রেটন উডস চুক্তি কী? ইতিহাস, উদ্দেশ্য ও এর পতনের কারণ | Forex School
Bretton Woods Agreement

ব্রেটন উডস চুক্তি: আধুনিক বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্মকাহিনি

ব্রেটন উডস চুক্তি (Bretton Woods Agreement) কি? 

ব্রেটন উডস চুক্তি ছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়েরর আর্থিক মন্দা থেকে বিশ্ব অর্থনীতিকে সুশৃঙ্খল পর্যায়ে আনার জন্য একটি ব্যবস্থা। এই চুক্তির অধিনে তৎসময়ে বিশ্বের বড়ো বড়ো অর্থনীতি গুলোর মধ্যে একটি স্থায়ী ও স্থিতিশীল মুদ্রানীতি ঘঠন করা হয়েছিলো। ১৯৪৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ার রাজ্যের ব্রেটন উডস শহরে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মাধ্যমে এই চুক্তি গৃহীত হয়। 

ব্রেটন উডস চুক্তির সময়কাল ও পটভূমিঃ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময় ছিলো বিশ্ব অর্থনীতির জন্য ভায়ল মুহুর্ত। উক্ত সময় একদিকে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট, বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক অস্তিরতা মোকাবেলা করাটা একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এই সময় আন্তর্জাতিক বানিজ্য ছিলো বিপর্যস্ত এবং পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের মুদ্রার মূল্যমানে এক চরম অস্থিরতা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে এবং একটি নতুন বৈশ্বিক আর্থিক কাঠামো গঠনের উদ্দেশ্যে ব্রেটন উডস সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সম্মেলনটি ১ জুলাই থেকে ২২ জুলাই, ১৯৪৪ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়।

ব্রেটন উডস চুক্তিটি কারা করেছিলো এবং কাদের জন্য করেছিলো? 

ব্রেটন উডস চুক্তিটি হয়েছিলো একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন এর মাধ্যমে। এই সম্মেলনে ৪৪ টি মিত্র দেশের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স, ভারত, চীন ও অষ্ট্রেলিয়া। এই ব্রেটন উডস চুক্তিটির মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন, মার্কিন অর্থনীতিবিদ হ্যারি ডেক্সটার হোয়াইট এবং ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কাইন্স। 

এই চুক্তিটি সংগঠিত হয়েছিলো মূলত বিশ্ব বাণিজ্য, এক্সচেঞ্জ রেইট এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য। এর মাধ্যমে আশা করা হয় যে, যেসব দেশ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ সেসব দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হবে। 

ব্রেটন উডস চুক্তির মূল উদ্দেশ্য গুলো কি ছিল? 

  • স্থির একটি এক্সচেঞ্জ রেইট প্রতিষ্ঠা করা
  • আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) এবং বিশ্ব ব্যাংক (World Bank) প্রতিষ্ঠা করা
  • আন্তর্জাতিক বানিজ্যকে সহজতর করা
  • মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রার অবমূল্যয়ন রোধ করা
  • অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়নকে উৎসাহ দেওয়া

এই চুক্তির তৎকালীন ফলাফল কি হয়েছিলো? 

  • মার্কিন ডলার রিজার্ব কারেন্সিতে (Global Reserve Currency) রূপ নেয়, যার মান স্বর্ণের সাথে নির্দিষ্ট করা হয়। স্বররণের দাম তৎসময় ১ আউন্স = ৩৫ মার্কিন ডলার নির্দিষ্ট করা হয়।
  • IMF ও World Bank-এর মাধ্যমে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোকে ঋণ সহায়তার মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে পুনর্গঠন করার সুযোগ দেয়া হয়।
  • সকল ধরনের বাণিজ্যিক প্রতিবন্ধকতা অনেকাংশে কমে আসে এবং আন্তর্জাতিক ভাবে বানিজ্য বৃদ্ধি পায়।
  • এই চুক্তির মাধ্যমে বিশ্ব অর্থনীতি একটি নতুন যুগে প্রবেশ করে। 

ব্রেটন উডস চুক্তিটি কখন এবং কেন বাতীল হয়? 

১৫ আগস্ট ১৯৭১ সাল, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ডলার এর সাথে স্বর্ণের মান থেকে করার ঘোষণা দেন। উক্ত ঘোষণার ফলে গোটা বিশ্বের মানুষ হকচকিয়ে যায়। তাই এই ঘোষণাকে ইতিহাসে "নিক্সন শক" নামে অভিহিত করা হয়। এই ঘোষণার ফলে কার্যত ব্রেটন উডস চুক্তিটি বাতিল হয়ে যায়। 

কেন বাতিল হলো?

  • মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিপুল পরিমাণ ডলার ছাপাতে থাকে, যার সমপরিমাণ স্বর্ণ সংরক্ষণ সম্ভব ছিল না। 

  • অন্যান্য দেশগুলো স্বর্ণের চেয়ে ডলার বেশি পরিমানে রিডিম করতে চাইলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বর্ণের রিজার্ভ হুমকির মুখে পড়ে।

  • চুক্তির কাঠামো রক্ষণ করা আর সম্ভব হয়নি।

ব্রেটন উডস চুক্তি বাতিলের প্রভাব কী ছিল?

  • এই চুক্তির মাধ্যমে ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট চালু করা হয়, যার ফলস্বরূপ মুদ্রার মান বাজারভিত্তিক নির্দিষ্ট হয়ে পড়ে।
  • বিশ্ব অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি ও মুদ্রার উত্থান/পতন বেড়ে যায়।
  • মার্কিন ডলার এর একচেটিয়া আধিপত্য বৃদ্ধি পায়, কারন ডলার তখন রিজার্ভ কারেন্সি।
  • বিশ্ব অর্থনীতি যদি আরো গতিশীল হয়ে ওঠে তবে তা ছিল অস্থির। 

এখন যদি ব্রেটন উডস চুক্তি বহাল থাকতো তবে কি হতো? 

  • বিশ্বের সকল মুদ্রার মান অনেক বেশি স্থিতিশীল থাকতো।
  • ক্রস-বর্ডার ট্রেড আরও সহজ ও পূর্বানুমানযোগ্য হতো।
  • ডলারের আধিপত্য কিছুটা সীমাবদ্ধ থাকতো।
  • উন্নয়নশীল দেশগুলো হয়তো আরও স্থিতিশীল আর্থিক পরিবেশ পেত।
  • তবে, আধুনিক প্রযুক্তি ও ডিজিটাল অর্থনীতির চাপে হয়তো এই সিস্টেম অনেকাংশেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ত।

ব্রেটন উডস চুক্তিটি ছিলো বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি সাহসী ও যুগপযোগী পদক্ষেপ। এই চুক্তিটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ভঙ্গুর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামো গঠনে মূখ্য ভূমিকা রেখেছিলো। যদিও এই ঐতিহাসিক ব্রেটন উডস চুক্তিটি এখন বাতীল, তবে এর প্রভাব ও শিক্ষা আন্তর্জাতিক বানিজ্য ও বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য প্রাসঙ্গিক বটে। আন্তর্জাতিক কারেন্সি সিস্টেম বুঝতে হলে এই ব্রেটন উডস চুক্তি সম্পর্কে গভীর অধ্যায়ন খুবই জরুরী। যারা আন্তর্জাতিক বানিজ্যের সাথে যুক্ত অথবা যারা কারেন্সি মার্কেটে ট্রেড করেন তাদের ক্ষেত্রে এর শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। 

What's Your Reaction?

Like Like 0
Dislike Dislike 0
Love Love 0
Funny Funny 0
Angry Angry 0
Sad Sad 0
Wow Wow 0